Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

ফসলের উন্নত জাত

গ্রিন সুপার রাইস-আগামী দিনের ধান


গোটা পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যার প্রধান খাদ্য ভাত। সে কারণে ফসল হিসেবে ধানকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের চিন্তা ভাবনার অন্ত নেই। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এসে ধান গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়। ধানের গাছকে খর্বাকৃতি করে দেয়ার মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি করার যে প্রচেষ্টা শুরু হয় বিজ্ঞানীদের সে প্রচেষ্টা দারুণভাবে সফল হয়। গত চার দশক ধরে বিশ্বের  বার্ষিক ধানের উৎপাদন ২৫২ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে ৬০০ মিলিয়ন টনে দাঁড়িয়েছে। উচ্চফলনশীল, সার সংবেদনশীল, আধা খর্বাকৃতির ধান জাতের সাথে উপযুক্ত উৎপাদন প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে বিধায় ধানের উল্লেখযোগ্য  উৎপাদন  বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামী ২০২৫ সন নাগাদ বর্ধিত চাহিদা মেটানোর লক্ষে ধানের উৎপাদন বাড়াতে হবে শতকরা ২৫ ভাগ। সে লক্ষ্য অর্জনে বিজ্ঞানীরা এখনই ব্যাপক পরিকল্পনা শুরু করেছেন। শুরু করেছেন নতুন নতুন ধানের জাত উৎপাদনের কর্মকাণ্ড। ধানের উফশী ইনব্রেড জাত এবং হাইব্রিড জাতের পর নতুন কি সম্ভাবনা  বিজ্ঞানীরা সৃষ্টি করতে চান সেটি আজ দেখার বিষয়।
উফশী ধান
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ধানের জাত উন্নয়নে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিয়েছিলেন উদ্ভিদ প্রজননবিদগণ। খাটো জাতের এক ধানের সাথে কৃষকের মাঠ থেকে সংগ্রহ করা অনেকগুলো লম্বা জাতের ধানের সংকরায়ন করা হলো। অতঃপর শুরু হলো খর্বাকৃতির উচ্চফলনশীল ধানের জাত নির্বাচনের কাজ। এ ধরনের গবেষণা গোড়াতে জাপানে আর ভারতে শুরু করা হলেও আমাদের আবাদি শ্রেণীর ধানে সাফল্য আসলো আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট তথা ফিলিপাইনের ইরিতে। বিজ্ঞানের এ কর্মকাণ্ডের কারণে ধান গাছের ফলনশীলতার আশ্চর্য রকম পরিবর্তন ঘটে গেল। নতুন জাতের গাছগুলো খর্বাকৃতির হয়ে গেল। সার, সেচ প্রয়োগ আর আধুনিক ব্যবস্থাপনার পূর্ণ সুফল এরা ভোগ কতে পারলে দেশী জাতের ধানের মতো এরা ঢলে পড়লো না। এদের পাতা খাড়া প্রকৃতির হওয়ায় পাতায় দু’পাশেই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চললো। ফলে এদের শিষ বড় হলো, শিষে বেশি করে ফুল ধরলো, অধিক সংখ্যাক ফুল ফলে পরিণত হলো। এ কারণে এসব জাতের ফলন বেড়ে গেল। এভাবে পাওয়া গেল সে সময়ের বিখ্যাত আই আর ৮, আই আর ২০ এসব জাত। এরই ফলশ্র্বতিতে বাংলাদেশেও খর্বাকৃতির  ধানের জাত উদ্ভাবন করা হলো। এসব জাতকে কাজে লাগিয়ে দিনে দিনে এসব উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত বিস্তৃতি লাভ করলো। এসব আধুনিক জাতের মাধ্যমে ধানের ফলন উল্লেখযোগ্য রকম বেড়ে গেল।

হাইব্রিড ধান
বিজ্ঞানীরা কেবল উফশী জাত নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারলেন না। পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আরো অধিক ফলনশীল ধানের জাত সৃষ্টি করা আবশ্যক হয়ে পড়লো। এবার আর সনাতন জাত সৃষ্টি করার কর্মকাণ্ড নয়। দুটি ধানের জাতের মধ্যে সংকরায়ন করে হাইব্রিড জাত সৃষ্টির চেষ্টা শুরু হলো। হাইব্রিড ধান উফশী ধান অপেক্ষাও কমপক্ষে শতকরা ১৫ ভাগ অধিক ফলন দেয় বলে চীন দেশে শুরু হলো হাইব্রিড জাত উদ্ভাবনের জন্য জোর গবেষণা। ধানে একটি ফুলে পরাগায়ন ঘটালে পাওয়া যায় একটি মাত্র ফল বা বীজ। ফলে বিকল্প কোনো কৌশলের সন্ধান করলেন বিজ্ঞানীরা। ধানের বুনো এক আত্মীয়ের মধ্যে পাওয়া গেল পুংবন্ধ্যা স্বভাব। বুনো ধানের এ স্বভাবটি সংকরায়ন পদ্ধতিতে নিয়ে আসা হলো আবাদি ধানের জাতগুলোতে। অবস্থাটা এমন দাঁড়ালো যে, সব গাছই হয়ে গেল স্ত্রী গাছ। ফলে পাশে রোপণ করে দেয়া হলো পুর্বষ গাছ। পুর্বষ গাছের পরাগরেণু স্ত্রী গাছের গর্ভমুণ্ডে স্থানান্তরিত হওয়ায় সহজেই তৈরি করা সম্ভব হলো ধানে হাইব্রিড বীজ। অতঃপর বিজ্ঞানীরা এ কৌশলকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করলেন নানা রকম হাইব্রিড জাত। চীন দেশে ব্যাপক সাফল্য নিয়ে আসলো হাইব্রিড জাত উৎপাদন প্রযুক্তি । ধানের ফলন বেড়ে গেল শতকরা ১৫-৫০ ভাগ পর্যন্ত। এ কৌশল ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে গেল চীনের সীমানা পেরিয়ে ভিয়েতনাম, ভারত, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশসহ আরো কিছু দেশে । ধানের ফলন বৃদ্ধিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করলো হাইব্রিড ধানের জাত।

সুপার রাইস
খর্বাকৃতির বা আধা-খর্বাকৃতির উফশী ধানের উদ্ভাবনের ফলে বিজ্ঞানীরা আর এক দাপ এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। বিভিন্ন ধানের জাতের এ কাঙিত বৈশিষ্ট্য একটি জাতে সন্নিবেশন করতে চাইলেন বিজ্ঞানীরা। এর জন্য তারা বাছাই করে নিলেন একটি বা দুটি উত্তম জাত। এদেরকে সংকরায়ন করলেন বহু সংখ্যক জাতের সাথে ধাপে ধাপে যেন অন্য সব জাতের উত্তম বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া যায় একটি ধানের জাতে। এর জন্য ধানের আদর্শ একটি জাতের রূপকল্পও দাঁড় করিয়ে নিলেন তারা। এভাবে এ নিয়ে চললো সংকরায়ন আর বাছাই কর্মসূচি। এভাবে পাওয়া কিছু সম্ভাবনাময় বংশধর থেকে পরিবেশানুগ এবং উপযোগী গাছ বাছাই করে নেয়ার লক্ষে কিছু বীজ পাঠানো হলো ধান উৎপাদনকারী নানা দেশের গবেষকদের কাছে।

সুপার রাইসের সাফল্য বিজ্ঞানীরা ঘরে তুলতে ব্যর্থ হলেন। এর কারণও একাধিক। একটি উত্তম জাত অনেক জাতের একাধিক বৈশিষ্ট্য সংযোজন করে উত্তম জাতের ফল আরো বৃদ্ধি করার বিষয়টি বেশ জটিল। উত্তম জাতে সংযোজিত নানা জাতের উত্তম বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি দু’একটি করে খারাপ বৈশিষ্ট্যের জিনও এতে সংযোজিত হলো। ফলে এ মাত্রায় ফলন বাড়াবে বলে আশা করা হয়েছিল ফলন সে রকম বাড়েনি। তাছাড়া সনাতন সংকরায়ন পদ্ধতিতে কাঙিত জিন সন্নিবেশিত হলো কিনা কিংবা হলেও এর মাত্রা কতটুকু তা জানা প্রায় ক্ষেত্রেই অসম্ভব থেকে গেল। ফলে সুপার রাইস নিয়ে যে স্বপ্ন ছিল তা আর বাস্তবে রূপ লাভ করলো না। কিন্তু সুপার রাইসের স্বপ্ন মুছে গেল বিজ্ঞানীদের  মন থেকে তা কিন্তু নয়। জিন প্রযুক্তির বিকাশ ও প্রসার সে স্বপ্নকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে  যাওয়ার পথ সৃষ্টি করলো।

গ্রিন সুপার রাইস
এটি বিজ্ঞানীদের আর এক স্বপ্নের ধান। আর এক সবুজ বিপ্লবের লক্ষে এক দল বিজ্ঞানী শুরু করেছেন নতুন এ ধান সৃষ্টির গবেষণা । মূলত এ গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন এক দল চীনা বিজ্ঞানী। এ প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছে চাইনিজ একাডেমি অব এগ্রিকালচারাল সাইন্সেন্স এ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা। এর সাথে রয়েছে চাইনিজ ৬টি বিখ্যাত সেন্টার, বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানসহ চীনের অতিরিক্ত ৯টি বিভিন্ন আঞ্চলিক ধান প্রজনন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এর প্রকল্পের অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইন্টারনেশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইরি), আফ্রিকান রাইস সেন্টার (ওয়ার্ডা) এবং এশিয়ার বেশ ক’টি দেশের জাতীয় কৃষি গবেষণা ও সমপ্রসারণ সিস্টেম সাথে রয়েছে চীনের ৫টি প্রাইভেট বীজ কোম্পানি।

সুপার রাইসের মতো নানা রকম ধানের জাত থেকে বৈশিষ্ট্য একটি জাতে নিয়ে আসার লক্ষে এখানেও কাজ চলছে। তবে সনাতন পদ্ধতিতে সংকরায়ন করে উত্তম বৈশিষ্ট্যাবলীর জন্য অপেক্ষা করার কৌশলই কেবল এখানে নিচ্ছেন না  বিজ্ঞানীরা। বরং সুনির্দিষ্ট কোনো জিন একটি নির্দিষ্ট জাত থেকে কোনো জাতে আনা হয়েছে কিনা তা বোঝার জন্য অন্য এক রকম নতুন প্রজনন পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিটির নাম মার্কার সহায়ক নির্বাচন ((marker assisted selection) সংক্ষেপে এক সধং ও বলা হয়। নির্দিষ্ট উঘঅ অংশ চিহ্নিত করার মাধ্যমে নির্দিষ্ট জিনকে শনাক্ত করার এটি একটি নতুন  ভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি। এ পদ্ধতির প্রধান সুবিধা এই যে, মার্কার উঘঅ এর সাথে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যেমন : রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, কীটপতঙ্গ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিংবা কোনো গুণগত বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিন শক্তভাবে সংযুক্ত থাকলে বহুসংখ্যক চারা থেকে উঘঅ নিয়ে নির্দিষ্ট উঘঅ টিকে শনাক্ত করার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নির্দিষ্ট বেশিষ্ট্যের উপস্থিতি সহজেই নির্ণয় করা যায়। অল্প সময়ে বহুসংখ্যক চারা গাছ মাঠে জন্মাবার আগেই এভাবে প্রয়োজনীয় গাছটিকে চেনা সম্ভবপর হয়।

শুরুতে আলোচনা করা যাক কি বুঝানো হচ্ছে ‘গ্রিন সুপার রাইস’ শব্দ তিনটি দিয়ে। অল্প উপকরণ নির্ভর উচ্চফলনশীল এবং অধিক ফলন বিশিষ্ট রোগ এবং কীটপতঙ্গ সহিষ্ণু ধান জাতকেই গ্রিন সুপার রাইস বলা হচ্ছে। এসব ধান গাছের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য সংযোজন করা হবে যেন এরা কম পানিতে উত্তম ফলন দিতে সৰম হয়। অর্থাৎ স্থানীয় ধানের জাতের পানি সাশ্রয়ী বৈশিষ্ট্য সংযোজন করে এরকম ধান গাছ পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া পানি ও খাদ্যোপাদানে সর্বোচ্চ ব্যবহারিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারলে এরা পানি ও পুষ্টি উপাদান সাশ্রয়ী হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া এসব জাতগুলোর কোনো কোনোটা হবে খরা সহিষ্ণু,  লবণাক্ততা বা ৰারকত্বসহিষ্ণু;  কোনো কোনোটা আবার হবে নানারকম রোগ সহিষ্ণু; কোনো কোনোটা এক বা একাধিক কীট প্রতিরোধী; কোনো কোনো জাতে থাকবে এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্য যা একে ‘গ্রিন’ তথা অক্ষত অর্থাৎ সবুজ রাখতে সহায়ক হবে এবং এরা উচ্চফলনশীল হবে। সনাতন পশ্চাৎ সংকরায়ন পদ্ধতি আর আধুনিক আণবিক প্রজনন পদ্ধতির সমন্বয় ঘটিয়ে উচ্চফলনশীল জাতগুলোতে সন্নিবেশন করা হবে এক একটি জিন। পাশাপাশি এদের ব্যবস্থাপনার কৌশলসমূহও উদ্ভাবন করা হবে। এভাবে সৃষ্ট জাতের শতকরা ৭০ ভাগ হবে হাইব্রিড প্রকৃতির আর শতকরা ৩০ ভাগ হবে ইনব্রেড জাত। এভাবে উৎপন্ন প্রাথমিক পর্যায়ের লাইনগুলো পৌঁছানো হবে এশিয়া ও আফ্রিকার ১৯টি দেশ ও অঞ্চলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষর জন্য। লক্ষ্য হবে এসব লাইন থেকে এলাকা ভিত্তিক কাঙিত ও প্রয়োজনীয় লাইনকে বাছাই করে নতুন জাত হিসেবে অবমুক্ত করা। কয়েকটি ধাপে এ কাজটি সম্পন্ন করতে চান বিজ্ঞানীরা। প্রথম ধাপটি হলো তিন বছরের। এ সময়ের মধ্যে উদ্ভাবিত ১৫টি উৎকৃষ্ট লাইন চলে যাবে জাতীয় ফলন পরীক্ষার লক্ষে অভিষ্ট দেশগুলোতে। এসব নির্বাচিত আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- নাইজেরিয়া, রোয়ান্ডা, তাঞ্জানিয়া, মালে, সেনেগাল, লাইবেরিয়া, মোজাম্বিক এবং উগান্ডা। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- লাওস, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনাম। দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান। এছাড়া রয়েছে চীনের ৪টি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল যথা- মিচুয়াম, গোয়াঙি, ইউন্নাম এবং গোইজোও। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার এসব অঞ্চলের ধানের ফলন শতকরা ৩০ ভাগ বৃদ্ধি করা। চীন সরকার এবং বিল ও মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে চলছে এ বিশাল গবেষণা কার্যক্রম।

এবার গ্রিন সুপার রাইস সৃষ্টির লক্ষ্য বেশ কিছু ভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিলেন বিজ্ঞানীরা। একটি দু’টি উন্নত জাত নয় বরং বেশ কয়েকটি উন্নত জাতকে নেয়া হয়েছে ভিত্তি জাত হিসেবে। অধিক সংখ্যক উন্নত জাতকে ভিত্তি জাত হিসেবে নেয়া এ প্রকল্পের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কোনো জাতটি অন্য সব জাতের সাথে সংকরায়নের মাধ্যমে উত্তম বংশধর তৈরি করবে তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। ফলে অনেক বছর ধরে এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার চেয়ে অনেক উত্তম জাত নিয়ে একই সময়ে নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তাতে একদিকে যেমন সময় বাঁচবে তেমনি নানা সংকরায়ন সংযোগ থেকে কাঙিত বংশধর পাওয়ার সুযোগও বেড়ে যাবে। অধিক সংখ্যক উন্নত জাত বাছাই করার আর একটি কারণ হলো এই যে, কোনো একটি জাত হয়তো অল্প ক’টি জাতের বৈশিষ্ট্য প্রকাশে সক্ষম হবে এবং অন্য আর একটি জাত হয়তো অন্য কয়েকটি জাতের বৈশিষ্ট্য প্রকাশে সক্ষম হতে পারে। বিভিন্ন জাতের সাথে সংকরায়নের পর উত্তম বংশধর সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে উন্নত জাতগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। সময় নষ্ট না করে সে পার্থক্যটাকে একই সময়ে কাজে লাগানো এ প্রকল্পের আর একটি বৈশিষ্ট্য। এর জন্য অবশ্য দক্ষ অনেক সংখ্যক উদ্ভিদ প্রজননবিদের প্রয়োজন হবে। চীনে এরকম প্রজননবিদের সংখ্যা বিশ হাজারের মতো। আর প্রকল্পের মূল কারিগর হিসেবে কাজ করছেন বেশ ক’জন চীনা বিশ্বখ্যাত উদ্ভিদ প্রজননবিদ। তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার আণবিক বংশগতিবিদ্যা তথা জিন প্রযুক্তিতেও বেশ দক্ষ। এ প্রকল্পের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো একটি উত্তম জাতে সব উত্তম জিনের সমাহার নয় বরং বেশ কয়েকটি উত্তম জাতে ভিন্ন ভিন্ন রকম উত্তম বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনের সমাবেশ ঘটানো। এতে একই সময়ে নানা উত্তম বৈশিষ্ট্য সংবলিত অনেক রকমের ধানের সম্ভাবনাময় বংশধর পাওয়া যাবে।

চীন দেশ ধানের জন্মভূমির একটি। ফলে এখানে রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ ধানের জাত। চীনের জাতীয় জিন ব্যাংকে জমা রয়েছে ৩৪২০০০ ধানের জাতের বীজ। রয়েছে কম্পিউটার ভিত্তিক এদের নানা তথ্য। এসব সংরক্ষিত ধানের জাত থেকে ৫০০ রকমের বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধানের জাতের সাথে সংকরায়ন করা হবে ৪৬টি ধানের উত্তম জাত। ধানের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ জিন আবিষ্কার করা হয়েছে। এসব জিনকে সন্নিবেশন করা হচ্ছে উন্নত জাতগুলোতে। ইতোমধ্যে নানা রকম সংকরায়ন কর্মসূচি থেকে প্রাপ্ত ফার্স্ট জেনারেশন লাইন সরবরাহ করা হয়েছে এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে। বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাককে এরকম লাইন সরবরাহ করেছে চীনা বিজ্ঞানীরা। ব্র্যাকের বিজ্ঞানীরা এদেশের বিভিন্ন রকম এলাকায় এসব লাইন জন্মিয়ে চেষ্টা করবে উত্তম লাইনগুলোকে বাছাই করে নেয়ার। আর এ রকম লাইন পেলে এদের বীজ বর্ধন করে পাওয়া সম্ভব হবে কাঙিত জাত।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদেরও কিছু লাইন সরবরাহ করেছে চীনা বিজ্ঞানীরা। এসব লাইনের মধ্যে সম্ভাবনাময় উচ্চফলনশীল লাইন পেলে তা সরাসরি নতুন জাত সৃষ্ট করতে পারে। অথবা এ ধরনের লাইনের উত্তম বৈশিষ্ট্য আমাদের দেশের প্রচলিত জাতগুলোতে স্থানান্তর করা যেতে পারে। তবে ফার্স্ট জেনারেশন এসব লাইন নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়াও কঠিন। এরা কোনো লাইনের চূড়ান্ত রূপ নয়। তাছাড়া এদের নিয়ে কোন বড় ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়নি।

ফলে এসব প্রাথমিক পর্যায়ের জাত থেকে কতটা কাঙিত লাইন পাওয়া যাবে সেটি দেখার বিষয়। তবে কয়েক বছর পর বিজ্ঞানীদের তৈরি করা সেকেন্ড বা থার্ড জেনারেশন ধানের লাইন পেলে কাঙিত জাত সৃষ্টির সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। যে বিশাল কর্মযজ্ঞ চীন দেশের বিজ্ঞানীরা শুরু করেছেন যে শুভ ফল বয়ে আনবে এক দিন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা সে দিনের প্রত্যাশায় রইলাম।

* প্রফেসর, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭

 

 

জাত পরিচিতিঃ

বর্তমানে এদেশে অধিক আবাদকৃত গম জাতের মধ্যে কাঞ্চন, আকবর, অঘ্রাণী ও প্রতিভা রয়েছে। তাছাড়া সৌরভ (বারি গম-১৯) ও গৌরব (বারি গম-২০) নামে ২টি উচ্চ ফলনশীল নতুন জাত অনুমোদিত হয়েছে।

 

গমের জাত

কাঞ্চনঃ

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট কর্তৃক ইউপি-৩০১ এবং সি-৩০৬ এর মধ্যে সংকরায়ণ করে কাঞ্চন জাত উদ্ভাবন করা হয়। এ জাত ১৯৮৩ সালে অনুমোদিত হয়। গাছের উচ্চতা ৯০-১০০ সেমি। কুশির সংখ্যা ৬-৭টি। গাছের নিশান পাতা খাড়া। শীষ বের হতে ৬০-৬৮ দিন সময় লাগে। প্রতি শীষে ৩৫-৪০টি দানা থাকে। দানা সাদা এবং হাজার দানার ওজন ৪৮-৫২ গ্রাম। অন্যান্য জাতের তুলনায় দানা আকারে বড়। চারা আবস্থায় প্রাথমিক কুঁশি মাটির উপরে অবস্থান করে। বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত১০৬-১১২ দিন সময় লাগে। এ জাতটি দীর্ঘ সময় ধরে চাষাবাদ হচ্ছে। বর্তমানে পাতার মরিচা দাগ রোগে আক্রান্তহওয়ায় জাতটির ফলন কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টর প্রতি ৩.৫-৪.৬ টন ফলন হয়। জাতটি দেশের সকল অঞ্চলে চাষের জন্য উপযোগী। বর্তমানে সারা দেশে কাঞ্চন গম খুবই জনপ্রিয়। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ ভাগ এলাকায় কাঞ্চন গমের আবাদ হচ্ছে।

 

আকবরঃ

আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র (CIMMYT) মেক্সিকোতে ও টোবারী নামাক ২টি জাতের মধ্যে সংকরায়ণের পর একটি কৌলিক সারি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে আনা হয়। পরবর্তীতে বাছায় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভাবিত জাতটি আকবর নামে ১৯৮৩ সালে অসুমোদিত হয়। এ জাতের গাছের উচ্চতা ৮৫-৯০ সেমি। কুশির সংখ্যা ৬-৭টি। পাতা কিছুটা হেলানো। নিশান পাতা খুবই চওড়া ও লম্বা। শীষ বের হতে ৫০-৫৫ দিন সময় লাগে। প্রতি শীষে ৫০-৫৫টি দানা থাকে। দানা সাদা, আকারে মাঝারি এবং হাজার দানার ওজন ৩৭-৪২ গ্রাম। পাতার গোড়ায় সাদা অরিকল থাকে। ফসল বোনা থেকে কাটা পর্যন্ত১০৩-১০৮ দিন সময় লাগে। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করে ফলন হেক্টরপ্রতি ৩.৫-৪.৫ টন হয়। জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল। বৃহত্তর ময়মনসিংহ, যশোর, কুষ্টিয়া ও খুলনা জেলায় এ জাতের ফলন বেশী হয়। তবে আকবর জাতের গম দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও চাষের জন্য উপযোগী।

 

অঘ্রাণীঃ আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র, মেক্সিকো হতে সনোরা/পি ৪১৬০ ই/ইনিয়া কৌলিক সারিটি ১৯৮২ সালে বাছাইকরণ নার্সারীর মাধ্যমে বাংলাদেশে আনা হয় এবং ১৯৮৭ সালে অঘ্রাণী নামে তা অনুমোদন লাভ করে। এ জাতের গাছের উচ্চতা ৮৫-৯০ সেমি, কুশির সংখ্যা ৫-৬টি। পাতা কিছুটা হেলানো, নিশান পাতা বড়। গাছের পাতা ও কান্ডে পাতলা মোমের আবরণের মতো বস্তুলক্ষ্য করা যায়। শীষ বের হতে ৫৫-৬০ দিন সময় লাগে। প্রতি শীষে ৫০-৫৫টি দানা থাকে। দানার রং সাদা, আকারে মাঝারি এবং হাজার দানার ওজন ৩৮-৪২ গ্রাম। পাতার গোড়ায় বেগুনি অরিকল থাকে। বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ১০৩-১১০ দিন সময় লাগে। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে ফলন হেক্টরপ্রতি ৩.৫-৪.০ টন হয়। জাতটি পাতার দাগ (ব্লাইট রোগ সহনশীল)। দেরীতে বপনের জন্য অঘ্রাণী জাতের গম বিশেষভাবে উপযোগী।

 

প্রতিভাঃ

থাইল্যান্ড হতে ১৯৮২ সালে প্রেরিত বাছাইকরণ নার্সারীতে কে-ইউ ১২ নামক একটি কৌলিক সারি বাংলাদেশে বাছায় করা হয় এবং ১৯৮৩ সালে তা প্রতিভা নামে অনুমোদিত হয়। গাছের উচ্চতা ৮৫-৯৫ সেমি। কুশির সংখ্যা ৬-৭টি। গাছের নিশান পাতা খাড়া। শীষ বের হতে ৬০-৭০ দিন সময় লাগে। শীষ লম্বা ও প্রতি শীষে ৩৫-৪৫ টি দানা থাকে। দানা সাদা, আকারে বড় ও হাজার দানার ওজন ৪২-৪৮ গ্রাম। ফসল বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত১০৫-১১০ দিন সময় লাগে। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৩.৮-৪.৫ টন ফলন পাওয়া যায়। গমের প্রতিভা জাত পাতার মরিচা ও পাতার দাগ রোগ সহনশীল।প্রতিভা জাতের গম দেশের সকল অঞ্চলে চাষ করা যায়।

 

সৌরভঃ

আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্রে নেকোজারী ও ভেরী জাতের মধ্যে সংকরায়ণকৃত একটি কৌলিক সারি ১৯৮৯ সালে এদেশে এনে বাছাই করা হয় যা ১৯৯৮ সালে সৌরভ (বারি গম-১৯) নামে চাষাবাদের জন্য অনুমোদিত হয়। গাছের উচ্চতা ৯০-১০০ সেমি। কুশির সংখ্যা ৫-৬টি। পাতা চওড়া, হেলানো ও গাঢ় সবুজ। নিশান পাতা চওড়া ও হেলানো। নিশান পাতার নীচের তলে মোমের মতো পাতলা আবরন থাকে। কান্ড মোটা ও শক্ত, ঝড় বৃষ্টিতে হেলে পড়ে না। নীচের গ্লুমের ঠোঁট বড়, প্রায় ৫ মিমি। শীষ বের হতে ৬০-৭০ দিন সময় লাগে। শীষ লম্বা, প্রতিটি শীষে দানার সংখ্যা ৪২-৪৮টি, দানার রং সাদা এবং হাজার দানার ওজন ৪০-৪৫ গ্রাম। বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত১০২-১১০ দিন সময় লাগে। উন্নত পদ্ধতিতে আবাদ করলে হেক্টরপ্রতি ফলন ৩.৫-৪.৫ টন পাওয়া যায়। জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং পাতার মরিচা রোগ প্রতিরোধী। সৌরভ গম দেশের প্রায় সকল অঞ্চলে চাষের জন্য উপযোগী।

 

গৌরভঃ

আন্তর্জতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্রে টুরাকো ও চিলেরো জাতের মধ্যে সংকরায়ণকৃত একটি কৌলিক সারি ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে আনা হয়। খুব উৎপাদনশীল জাত হিসেবে সারিটি বাছায় করা হয় যা ১৯৯৮ সালে গৌরব (বারি গম-২০) নামে সারা দেশে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন লাভ করে। গাছের উচ্চতা ৯০-১০২ সেমি। কুশি ৫-৬টি। পাতা গাঢ় সবুজ। নিশান পাতা খাড়া, সরু ও ইষৎ মোড়ানো। নীচের গ্লুমের ঠোঁট ছোট প্রায় ২ মিমি। শীষ বের হতে ৬০-৬৫ দিন সময় লাগে। শীষ লম্বা, অগ্রভাগ সরু। প্রতি শীষে ৪৫-৫০টি দানা থাকে। দানার রং সাদা এবং হাজার দানার ওজন ৪০-৪৮ গ্রাম। জীবনকাল ১০০-১০৮ দিন। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৩.৬-৪.৮ টন ফলন পাওয়া যায়। জাতটি পাতার মরিচা রোগ প্রতিরোধী এবং পাতার দাগ রোগ সহনশীল। এ জাতটি তাপ সহিষ তাই দেরীতে বপন করলে ভাল ফলন দেয়। বর্তমানে গম জাতসমূহের তুলনায় এ জাত ১০-১২ ভাগ বেশী ফলন দেয়।